সংবাদ আপডেট

ঢাকায় মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ওরফে টিপু হত্যার পেছনের কারণ অনেকটাই উদ্‌ঘাটিত হয়েছে বলে দাবি করছে তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র। এর মধ্যে অপরাধজগতের (আন্ডারওয়ার্ল্ড) নিয়ন্ত্রণ, স্থানীয় রাজনীতির বিরোধ এবং ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা—এই তিনটি বিষয় এই হত্যার পেছনে মূল কারণ হিসেবে কাজ করেছে। এ–সংক্রান্ত প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী একাধিক বাহিনী জড়িতদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান অব্যাহত রেখেছে।

আরও পড়ুন

‘বিচার নাই, কার কাছে চাইব’

‘বিচার নাই, কার কাছে চাইব’

এরই মধ্যে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণকারী একজনকে বগুড়া থেকে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁর নাম মাসুম মোহাম্মদ ওরফে আকাশ। ডিবি বলছে, এই মাসুম ছিলেন ‘শুটার’ (যিনি জাহিদুলকে গুলি করেন)। তাঁকে ভাড়া করা হয়েছিল।

তবে কে বা কারা ভাড়া করেছিল, সে বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবির মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার রিফাত রহমান শামীম গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, মাসুম কয়েকজনের তথ্য দিয়েছেন। তবে তদন্তের স্বার্থে সেটা এখন বলা যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন

‘এক থেকে দেড় মিনিটেই হত্যা করা হয় জাহিদুলকে’

‘এক থেকে দেড় মিনিটেই হত্যা করা হয় জাহিদুলকে’
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে রাজধানীর ব্যস্ত সড়ক শাহজাহানপুরের আমতলা মসজিদ এলাকায় জাহিদুল ইসলামকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি এ সময় বাসায় ফিরছিলেন। তাঁর গাড়ি যানজটে পড়ার পর মোটরসাইকেলে করে আসা হেলমেট পরা এক যুবক জাহিদুলকে লক্ষ্য করে গুলি করেন। তাঁর এলোপাতাড়ি গুলিতে রিকশারোহী কলেজছাত্রী সামিয়া আফরান জামাল গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।

* পাঁচ দিন আগে খুনি ভাড়া করা হয়। * ‘শুটার’ গ্রেপ্তার বগুড়া থেকে। * পরিকল্পনাকারীদের কয়েকজন শনাক্ত।

জাহিদুল হত্যা মামলাটি এখন তদন্ত করছে ডিবি। তদন্তসংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাহিদুলকে হত্যার নেপথ্যের ব্যক্তিরা যুবলীগের কর্মী রিজভী হাসান ওরফে বোঁচা বাবু হত্যা মামলার আসামিদের ক্ষোভকে কাজে লাগান। বোঁচা বাবুকে ২০১৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর মতিঝিল এজিবি কলোনিতে গুলি করে হত্যা করা হয়। বাবুর বাবা আবুল কালাম হলেন জাহিদুল ইসলামের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। আর্থিকভাবে দুর্বল কালামকে সব সময় সহযোগিতা করতেন জাহিদুল। দুজন সব সময় একসঙ্গে থাকতেন। এমনকি জাহিদুলকে যখন হত্যা করা হয়, তখনো তাঁর সঙ্গে গাড়িতে ছিলেন কালাম।

বোঁচা বাবু হত্যা মামলার খরচও জাহিদুল চালাতেন, এ কারণে আসামিরা ক্ষুব্ধ ছিলেন জাহিদুলের ওপর। ওই মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিদের মধ্যে ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক ওরফে কানা ফারুক, তাঁর সহযোগী নাসির উদ্দিন ও সুমন শিকদার ওরফে মুসা অন্যতম।

কানা ফারুক, মুসাসহ অন্য আসামিরা জামিনে বেরিয়ে এসে মামলা মিটমাট বা বাদীর সঙ্গে আপস করার জন্য জাহিদুলকে ধরেন। জাহিদুল এতে রাজি না হওয়ায় তাঁরা ব্যাপক ক্ষিপ্ত ছিলেন। এর মধ্যে ওমর ফারুক ওরফে কানা ফারুক মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতার মাধ্যমে তদবিরও করছিলেন। কানা ফারুকের ধারণা, এই হত্যা মামলার কারণে তিনি থানা কমিটির নেতা হতে পারছেন না এবং জাহিদুলও সেটা চান না, তাই মামলা মিটমাট হচ্ছে না।

মুসা একসময় শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রকাশ-বিকাশ গ্রুপের ‘কিলার’ বা পেশাদার খুনি ছিলেন। পরে শাহজাহানপুর-খিলগাঁও এলাকার পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ ওরফে মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিকের হয়েও কাজ করতেন। কারাগারে যাওয়ার পর মুসার সঙ্গে কানা ফারুকের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মুসা ও নাসিরকে প্রথম উদ্বুদ্ধ করা হয় জাহিদুলকে হত্যার জন্য। এই হত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দুজনের ভূমিকা রয়েছে বলে তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাঁকে খুঁজছে র‌্যাব ও পুলিশ।

অপরদিকে যুবলীগ সাবেক নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট ও খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ারা যখন পুরো মতিঝিল, শাহজাহানপুর, খিলগাঁও এলাকার অপরাধজগৎ, ফুটপাতের চাঁদাবাজি, এজিবি কলোনির সামনের কাঁচাবাজার, ক্রীড়া পরিষদ, রেলওয়েসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের দরপত্র নিয়ন্ত্রণ করতেন, তখন এসব খাতের আয় থেকে পলাতক তিন শীর্ষ সন্ত্রাসী মানিক, জিসান ও প্রকাশ-বিকাশ গ্রুপ একটা ভাগ পেত। সম্রাট ও খালেদ মাহমুদরা ক্যাসিনো–কাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর মতিঝিল এলাকা এবং ক্রীড়া পরিষদ ও রেলওয়ের দরপত্র নিয়ন্ত্রণ চলে যায় জাহিদুল ইসলামের হাতে। এরপর থেকে অপরাধজগতের ওই তিন শীর্ষ সন্ত্রাসীর ভাগও বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কোণঠাসা হয় সন্ত্রাসী মানিকের গ্রুপ। পলাতক মানিকের হয়ে এলাকায় অপরাধজগতের সমন্বয় করতেন কাইল্যা পলাশ নামের আরেক তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী।

জাহিদুল হত্যার পরিকল্পনা, খুনি ভাড়া করা ও অস্ত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে কাইল্যা পলাশের ভূমিকা ছিল বলে তথ্য পেয়েছে তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র। ওই সূত্র জানায়, জাহিদুলকে হত্যার পরপর কাইল্যা পলাশ মুঠোফোনে মানিকের সঙ্গে প্রায় আধা ঘণ্টা কথা বলেন। এরপর আরও কয়েক দফায় মোট প্রায় দুই ঘণ্টা তাঁদের মধ্যে কথোপকথনের তথ্য পাওয়া গেছে।

হত্যা পরিকল্পনার পর জাহিদুলের গতিবিধি অনুসরণ করতেন বোঁচা বাবু হত্যার আরেক আসামি নাসির উদ্দিন। তিনি ঘটনার দিন কিছুক্ষণ পরপর মুসাকে জাহিদুলের অবস্থান জানান, তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে সে তথ্যও পাওয়া গেছে বলে জানা যায়। বোঁচা বাবুর হত্যার অন্যতম কারণও ছিল কোরবানির পশুর চামড়ার ব্যবসা নিয়ে নাসিরের সঙ্গে বাবুর বিরোধ।

এখন কানা ফারুক, কাইল্যা পলাশ, নাসির ও মুসাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টায় আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই বিষয়ে অগ্রগতি আছে বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা।

পাঁচ দিন আগে ‘শুটার’ ভাড়া করেন পরিকল্পনাকারীরা

জাহিদুল হত্যার পরিকল্পনাকারীরা ঘটনার পাঁচ দিন আগে ‘শুটার’ মাসুমকে ভাড়া করেন বলে জানিয়েছে ডিবি। মাসুমকে গ্রেপ্তারের পর গতকাল দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার। তিনি বলেন, ঘটনার তিন দিন আগে কমলাপুরের আইসিডি কনটেইনার ডিপো এলাকায় অপরিচিত এক ব্যক্তি এসে মাসুম ও তাঁর এক সহযোগীকে একটি মোটরসাইকেল ও অস্ত্র দিয়ে যান।

ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, ঘটনার আগের দিনও (গত বুধবার) জাহিদুলকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে এজিবি কলোনিতে গিয়েছিলেন মাসুম ও তাঁর সহযোগী। তবে সেদিন তাঁকে সুবিধামতো না পেয়ে তাঁরা ফিরে যান। পরদিন বৃহস্পতিবার রাতে শাহজাহানপুরের আমতলা এলাকায় সুবিধামতো পেয়ে জাহিদুলকে হত্যা করেন তাঁরা।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, হত্যার পরদিন রাতে ঢাকা থেকে একটি গাড়িতে করে জয়পুরহাটে যান শুটার মাসুম। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তিনি ভারতে যেতে চেয়েছিলেন। যেতে না পেরে বগুড়া চলে আসেন। তবে হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও মোটরসাইকেল উদ্ধার হয়নি। এসব উদ্ধারের চেষ্টা চলছে বলে জানান ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার। পাশাপাশি মাসুমের সহযোগীকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

ডিবি জানায়, মুগদা-গোড়ান এলাকার শরীফ হত্যাসহ চার-পাঁচটি মামলার আসামি এই মাসুম। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ডিবিকে বলেছেন, কেবল টাকার জন্য তিনি এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত হন। গ্রাফিকস আর্টস নিয়ে লেখাপড়া করে মুগদা এলাকায় কেব্‌ল টিভির ব্যবসা করতেন মাসুম। তাঁর স্ত্রী ও সন্তান আছে। তাঁর গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে।

আলোচিত সংবাদ

বিজ্ঞাপন